বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

বাসবো ভালো

বাসবো ভালো
একশোয়েরো অধিক বছর
কথা দিলাম।

পাখির মতো
মুক্ত স্বাধীন
ফুলের মতো
রঙে রঙিন
ঝড়ের মতো
ওলট পালট
নদীর মতো
দু-কূল ভাসা
বাসবো ভালো
কথা দিলাম।

দূর আকাশের
নীলের মতো
বিস্তারিত সবুজ ঘাসের
শয্যা যেমন
তেমন করে বাসবো ভালো
তোমায় আমি
কথা দিলাম।

অলৌকিক মদের গেলাস

গেলাসে অলৌকিক মদ
মদ নয় যেনো রক্ত
রক্তের'চে বেশী নীল বিষ
নীল বিষে শিস্ কাটে ঠোঁট।

মেঘবার্তা

মাংস ও আধখানা চাঁদের কাবাব
আকাশ মোড়ানো গ্লাসে নক্ষত্র ময়ুরের নাচ
আর কিছু সেতারের শ্রাগ

তার কতটুকু আমার
ঠিক কতটুকু পান করে তবে
হারাবো আমি শরত সন্ধ্যার ভান

অপেক্ষা

আমরা যারা শিখিনি চাষবাস ফসলের গীত
গুলালিতে পাখি হত্যা
ইস্পাতের নলের ভেতর গরম বারুদ
রাজন্যের তোষামোদে যারা আজো অপটু
প্রতিঘাতে ক্ষরণে যারা বিপন্ন শামুক
আমাদের পকেট-ভর্তি ফুল পাখি লতার বিষাদ
আমরা অপেক্ষায় আছি
পরাক্রান্ত খামে করে আসবে খাদ্য ও রোদ

চিত্রকল্পদ্রুম

সারারাত ভেঙ্গে ভেঙ্গে গেছে একটি রুপালি ডানার চাঁদ
রক্ত ও বরফে জমাট বেধেছে শিশুদের হলুদ উপাস
ফুটপাতগুলো সব সরে দাঁড়িয়েছে
ঘর ঘুমাচ্ছে,ফ্রীজ-টিভি চুপচাপ,শুধু জেগে আছে আমার ফুসফুস
জানালার আলোগুলো সহমরণে গেছে অন্ধকবরের সাথে
তরুণ বৃক্ষরা রাত জেগে পাহারা দেয় অসহায় পাতা ও শেকড়
দৌড়ে ধরতে পারিনি
পালিয়ে গেছে মতিঝিলের ছিলান সড়ক

বিভ্রম

ঘন অন্ধকার শ্রাবনের বন্ধ্যা দুপুরের সাথে যেতে
আমি দেখেছি হে ভ্রম তোমাকে
যেতে যেতে তুমি কোথায় হরিয়ে গেলে
আমি বিকেল সন্ধ্যা রাত
রাত তামাদি করে অঝোর বৃষ্টির ভোরে
আকাশ থেকে পেরে এনেছি মেঘরঙ

আমি খুঁজেছি তোমাকে
নিজেকে দুভাগ করে যৌথ জন্মন্ধ চোখে
মেঘের দুরন্ত ঘোড়ায় চেপে বিষুব রেখার দুইপাশে

শ্রাবণের আকাশ নেমে আসে মগজের কোষে
প্রকোষ্টে লম্পট চিত্রের ভ্রম
কখনো ল্যাম্পপোস্ট
কখনোবা শিংওলা হাতি
কিংবা মুন্ডহীন মোরগের যতি
বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার পেছনে পিছু নিয়ে
আমি পাইনি খুঁজে হে ভ্রম তোমাকে

চিঠি

পকেটে জমানো যত দ্বাদশীর আহলাদী চাঁদ
তোমাকে পাঠাবো সবই
ধাতব জলের খামে জলপতনের শব্দ জুড়ে দিয়ে
বৃষ্টির বিপরীতে শিলালিপি
পতিত নক্ষত্র আর চাঁদের যৌথ রসায়ন
তুমি পেয়ে যাবে
আলাদা করে পাঠাবো আমার মজ্জা ও করোটির রোদ

বিরোধ

বেদনা খুঁড়ে পারিনি জাগাতে শহর
ভেঙ্গে চুড়ে স্বপ্ন ও সীসার কবিতা
লিখতে পারিনা আর
ভণিতার বিভ্রম
পারিনি ছুঁতে নিভৃতি
শুন্যবৃত্ত সময়ের ওম
পাক খেয়ে উঠে শুধু
সত্তা ও শহরের বিরোধ

লৌহজাত

যতদিন না হতে পেরেছি বিমুঢ় ধাতব
হাড়মাংসমজ্জার ভাঁজে পোক্ত করে অযুত লোহিত আগুন
আমি তো আর কিছু নই
শুধু বিমুর্ত বীর্যের নরোম ছায়া
ভেঙ্গে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো আষাঢ়ের ঠুনকো কাদার ইমেজ
জীর্ণ ক্যানভাসে অমুলক ভাঙ্গনের চিত্রকল্পকলা
লোহার ফুটেজে আমি নর্দমার কারুময় ভ্রুণ
আমি ভুল প্রেসে ছাপা লৌহজাত লোহার কুসুম

তোমাদের শহরে

তোমাদের শহরে ট্রেন থেকে নেমে
করেছি নদীপাঠ, মৌনতার ঘাটে জলের স্মরণ

আরো বেশী স্ফীত হয়ে গেছে এই শহর
শহরের মজ্জা ও মেদ
মোড়ে মোড়ে বেড়েছে প্রসাধিত বিলবোর্ড
ভ্রমের বিভেদ
পুরোনো সড়কগুলো সব নতুন পাথরে বাঁধা-পাষাণ
আমি তার পাইনা খুঁজে ধুলাপথ
পাত্রপ্রত্ন লুন্ঠিত দুপুর ও রাত
বস্তিতে জীবনের অন্য অনুবাদ আমিও খুঁজেছি একদিন

হেঁটে হেঁটে পার করে পোড়ামাংস-লালনীল বিপনী বিলাস
বৈঠকি উপমার ক্ষোভ, ভাষার বিক্ষোভ
আমার আর হলোনা পাওয়া আত্মমগ্ন আমার শহর

যদি তুমি যেতে চাও

যদি তুমি যেতে চাও তবে যাও
যতটুকু পথ পাড় হলে পরে
তুমি ফেরাবে আষাঢ় সন্ধ্যার চোখ
আমি তার চেয়ে বেশী দীর্ঘকাল পোড়াবো আমার শ্লীলতা
অভ্রনীল মুগ্ধতার দীঘল নদীর ক্ষয়ে
নীলপাথর সৌধের আমার কবর

আশা করি এর চেয়ে আরো বেশী সুখে তুমি মুড়ে থাকবে
অমন চন্দ্রময় কপালে এঁকে নীল নক্ষত্রের টিপ
নগরে নগরে বাড়াবে তোমার বিদুষী গন্ধের সুহৃদ
তোমার নুপুরের ঝড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাবে পুরুষপ্রাসাদ
ততদিনে আমি না পুরুষ, না নারী, না ক্লীব, শুধুই মানুষ

চৈত্রবোধ

জলের সখ্যতা মেনে যতবার নেমেছি জলে
জলারণ্য জলের পাহাড়ে পুঁতেছি বাঁশঘর, বেদনার সুকৃতি
তোমরা ফিরিয়ে রেখেছো মুখ
জানিনা কী মুগ্ধ অভিশাপে কিংবা ভয়ে
থেকেছো সন্তর্পন দূরত্বের অজুহাতে
আমি একাকী জলের শ্লেটে লিখেছি জলকাব্য গাঁথা
নির্বাসন দন্ডের খড়গ মাথার উপরে নিয়ে
স্থলের ত্রিভুজে পুনরায় করেছি বাহুর বিস্তার
ঝরাপাতার মাঠে বানিয়েছি ঘাসঘর
ফিরিয়ে রেখেছো মুখ তোমরা তবুও

বৃষ্টিপাঠ ১

বৃস্টি বুঝি আজ সবদাগ ধুয়ে মুছে দেবে
সব বিবাদ আর পুরনো কলহ
আকাশ ভাঙ্গা এই বৃষ্টির পরে
থিতুবে দ্রব্যমুল্যের আগুন
বেকারেরা চাকরী পাবে
থাকবে না ট্রাফিক জ্যাম এবং
হাসপাতাল থেকে রোগীরা
হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে যাবে

অবরুদ্ধ

আমি অন্ধকারে দমবন্ধ খোপে
জানালার ওপাশে আলো ও বাতাস
আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে
মাথা ঠেকেছে কংক্রীট ছাদে
জানালার ওপাশে আকাশ
হাত বাড়ালেই আলো ও বাতাস
আকাশ
আমি শুধু অন্ধকারে দমবন্ধ খোপে

জনপ্রতিনিধিদের বাধ্যতামূলক ইমেইল এড্রেস থাকা প্রয়োজন

কারণে-প্রয়োজনে মানুষকে কাউন্সিলর-চেয়ারম্যান-এমপি-মন্ত্রীদের কাছে যেতেই হয়।যেতে হয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে।কিন্তু এই যাওয়াটা কখনোই সুখের হয়না।লেফট-রাইট করতে করতে নাকাল হয়ে কোনো কোনো ভাগ্যবান অবশেষে দেখা পান কাঙ্খিত সেই পরমজনের।কারো কারো এই সৌভাগ্য ঘটেইনা।কেউ কেউ নিজেই ইতি টানেন নিজের প্রয়োজনের।দিনের পর দিন অন্যান্য কাজের বারোটা বাজিয়ে শুধু একটা স্বাক্ষর বা সুপারিশের জন্য ধর্না দেয়ার এই সংস্কৃতি বন্ধ করা প্রয়োজন।
বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে আসীন হযেছেন ক্ষমতায়।স্বপ্ন দেখালেও রুপরেখাটা এখনো বলেননি তারা।কিভাবে কি হবে মোস্তফা জব্বার সাহেবও স্পস্ট কিছু জানেননা আজতক।সভা-সেমিনারে প্রশ্ন উঠলে মন্ত্রী মহোদয়রা বিষয়টি এড়িয়ে যান সন্তর্পনে।
কিন্তূ এর শুরুটি করা যায় খুব সহজেই।সরকার যদি সকল জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদেরকে ইমেইল এড্রেস খোলা ও তা নিয়মিত চেক করে রিপ্লাই দেয়া বাধ্যতামুলক করে দেয়,তাহলে মানুষের প্রয়োজনীয় যোগাযোগের ভোগান্তিটি অনেক অনেক কমে যায়।বাচেঁ সময়।নিশ্চিত হয় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা।
এই সময়ে আমি/আমরা ই-গভর্নেন্স বলতে শুধু কিছু ফরমের ডাউনলোড সুবিধাকে বুঝিনা।ফরম জমা দেয়া ও এর আপডেট জানার সুযোগও প্রত্যাশা করি।জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদেরকে ই-মেইলের মাধ্যমে জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রাথমিক এই পদক্ষেপটি রাখতে পারেন।

মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

প্রেমের কবিতা

কতদিন কতরাত্রির কোলাহল জমিয়ে রেখেছি তুলে
ফুলতোলা ফোনের রিসিভারে
তুমি আর আমি আমি আর তুমি
পূড়িয়েছি কত কাঠখড় স্বপ্নের নীলকন্ঠ ধূপে
সমুদ্রস্নানের পরে পুনরায় ঝর্ণার হিম স্তব্ধতায় হয়েছি বিশুদ্ধ আরো
তারপর তারও বহুপরে এক বৃষ্টি সন্ধ্যার ভোজে
রুপোচাঁদে ডুবে ভেসেছি সংসারে
আজ বহুদিন পরে
ঢাকার লুকোচুরি বৃষ্টির ভেতরে,সন্ধ্যায়
পুনরায় লেকের পাড় ধরে যেতে যেতে
আবারো ছুঁয়েছি আমরা তোমাকে আমাকে

বৃষ্টির সাথে আমি হারিয়ে যেতাম

বৃষ্টি ও বৃষ্টি তুই কি কাঁদতে পারিস....

অন্য অনেক কিছুর মতো বৃষ্টিতো এখন আমার পর, দূরের কেউ। যদিও বৃষ্টি এখনো আমাকে ভুলে যায়নি। বৃষ্টি এখনো আমাকে ডাকে, হাতছানি দেয়। গান শোনায়। নৃত্যের মুদ্রা তুলে ঢাকার পাষাণ পাথরে বাঁধা আমার মন গলাতে চেষ্টা করে। আমি যতই গা বাঁচিয়ে চলি না কেন, মাঝে মধ্যে দুষ্টুমি করে আমাকে ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টির ডাকে আমারো সাড়া দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে অনেক আগের মতো হারিয়ে যেতে। কিন্তু এই নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা মানিব্যাগ আর মোবাইল বাঁচাতে গিয়ে তা আর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি এত কাছ থেকে আমাকে ডাকে কিন্তু আমি মুখ ফিরিয়ে রাখি- এ কষ্ট আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। কিশোর বেলায় পড়া একটা কবিতার লাইন ‌'বৃষ্টি আমার জন্মাবধি দুঃখগুলো মুছে নাও'- এখনো বৃষ্টি এলেই আমার অন্তরে অনুরণিত হয়। এক সময় নিয়মিত বৃষ্টিকে দিয়ে দুঃখ ধোয়াতাম। তখন এখনকার মতো ছাতা পোষতাম না। কখনো তা থৈ সুরমা এপার-ওপার করে, কখনো নির্জন টিলার বুক চিড়ে যাওয়া মেঠোপথের গভীরে আমি আর বৃষ্টি, বৃষ্টি আর আমি অনুভূতি বিনিময় করতাম। বৃষ্টি আমাকে স্থিরতা দিত, মুগ্ধতা দিত। বৃষ্টির সাথে নৌকায় হাওর মন্থনের কিছু টুকরো স্মৃতি মাঝে মধ্যে আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। বৃষ্টি আমাকে কী না দিয়েছে আর কী না দিতে পারতো!
একটা সময় ছিল, যখন বৃষ্টির কান্নাও আমি শুনতাম। সে কি অঝোর অবোধ কান্না। অবিরাম তিনদিন চারদিন। থামাথামি ছিল না মুহূর্তের জন্যো। বুকের ভার শূন্য করে তবেই থামতো। এখন আর বৃষ্টির কান্না শুনিনা। বৃষ্টি আসলে চেষ্টা করি- কান পেতে শুনতে। জানি না বৃষ্টিও কি ইদানিং মানুষের মতো আবেগশূন্য হয়ে গেছে কিনা।
বৃষ্টি বিষয়ক নানান স্মৃতি, অনেক অপ্রাপ্তির মধ্যে একটা দৃশ্য আমাকে খুবই আপ্লুত করে, উদ্দীপ্ত করে তা হলো বৃষ্টির স্পর্শে নারীদের ময়ূর হয়ে যাওয়া। নাগরিক ব্যস্ততার গালে চড় কষিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি যদি চলেই আসে- নারীরা মানে কিশোরী, তরুনী এমনকি প্রৌঢ়রা, বিশেষ করে যারা চলার পথে রিকশায় থাকে তারা রিকশার হুড খুলে দিয়ে ময়ূরের মতো পাখা মেলে দেয়। দৃশ্যটি বড়ই মনোহর, স্বগীর্য় আর বোধ জাগানিয়া।
বৃষ্টির কতরূপ যে একজীবনে দেখা হয়ে গেলো! ভরা বষার্য় চিম্বুক পাহাড়ে বৃষ্টির একরকম রূপ। আবার সুনামগঞ্জের হাওরে অন্যরকম। ঢাকার বৃষ্টি একেক জায়গায় একেক রকমের। মতিঝিলের ট্রাফিক জ্যামের বৃষ্টি আর ধানমণ্ডি লেকের বৃষ্টির তফাৎ গদ্য কবিতা আর চতুর্দশপদীর মতো। তবে আমার এখনো দেখা হয়নি শিলং আর চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির সৃষ্টিছাড়া উল্লাস।
বৃষ্টিই পারে মুছে দিতে পাড়ায় পাড়ায় কবর খননের উৎসব আর আমাদের মেরুদণ্ডের পুরনো জখম।
রমনার সামনে দিয়ে যেতে আসতে মাঝে মধ্যে ভাবি একদিন তুমুল বৃষ্টিতে রমনায় বৃষ্টি উৎসব করবো। বন্ধুদের বলবো মোবাইল মানিব্যাগ রেখে আসতে। রমনার সুবজে লুটোপুটি খেয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো। পুরনো সখ্যতা ঝালাই করে নেবো। সীসা আর কার্বনে ক্লান্ত, ন্যুব্জ আমি আবারো আমার আমি হয়ে উঠবো।

জীবন্মৃত

আমার চেয়ে কে আর বেশী বিষে বিষে নীল স্বপ্নভূক
কে আর পেয়েছে এত স্খলিত মুদ্রার পতিত অসুখ
ছলনার শিল্পিত ফাঁদে
রাগে ও অনুরাগে
কে আছে এমন আমূল দু’ফাঁক
তীব্র আর্তনাদে কেঁদে কেঁদে
নোনা জলে সেঁচে প্রগাঢ় খেদ
ব্যথিত ধ্র“পদ বিষাদের ভারে
নদীভাঙা জলের কিনারে
ক্লান্তশূন্য এমন কে আর আছে
পান করে অমৃতের গরল আস্বাদ
অবিশ্বাসী ছুরির আঘাতে
কে আর বেশি মৃত আমার চেয়ে,জীবিত থেকে’ও

পথ

আকাশটা আজ আষাঢ়ের বউ হয়ে পাছা দোলাচ্ছে। মেঘের ঘাগরা পরা আকাশের কারণে সোয়েটার পরার মতো ঠান্ডা বাতাস ঘর ছেড়ে বেরুতে সায় দেয় না। এমন বিষণ্ণ, মনে না ধরা দিনেও আমাকে শেষ পর্যন্ত বেরুতেই হলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘাড়ের বোঝা ঠিকঠাক মতো নামতে নামাতে শহরের অনেক সড়কেই পানি জমে এক হাঁটু। তা হোক। ভেসে যাক এই নগর, নাগরিক ব্যস্ততা। আমি ফাঁক বুঝে সুবিমল মিশ্র, অক্টাভিও পাজ এবং মাহমুদুল হকে চোখে বুলালাম। সাথে চললো চা ও সিংগারা। কিছুক্ষণ বেনসনের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিলাম চাপচাপ টেনশনের অংশ বিশেষ।
তার মানে, আমি, মানে হিরন্ময় পথিক ওরফে শুভ ভালই আছি। খাচ্ছি-ঘুমুচ্ছি। চা সিংগাড়ার সাথে বইয়ের পাতায় চোখ ফেলছি, বেনসনের ধোয়ায় টেনশন উড়াচ্ছি- সব মিলিয়ে ভালো নয়তো কি? হ্যাঁ, ভালো বুঝি ওই চন্দ্রিমা উদ্যানের প্রেম (!) যে গাছের গোড়ায় গায়ে গা লাগিয়ে বসলেই মনে হবে ভালো। স...ব ভালো। যে, ট্রাফিক সিগনালে একচান্সে সবুজ বাতি দেখেনি জীবনে তার আবার ভালো কোত্থেকে আসবে। ভালো তো পকেটের রুমাল নয়, হাত দিলেই বের হয়ে আসবে।
বাংলা মোটর মোড়ে রেড সিগনালে আটকা পড়ে মনে ভাসে তিথির ছবি। তিথি বোধ হয় এখনো জানে না ওর প্রতি আমার ভালবাসার কথা। থাক, না জানুক। তবুও সে এখন পর্যন্ত আমার প্রথম এবং একমাত্র ভাল লাগা। তবে ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। কেননা পুরুষের মনতো। এবং আমি তো জলজ্যান্ত পুরুষই। যদিও তিথিকে কেন্দ্র করে এখনো অনেক সময় অদ্ভুত অদ্ভুত নষ্টালজিক স্বপ্ন কিংবা ঘোরে ডুবে থাকি। শেষ পর্যন্ত এই ডুবে থাকাই হয়তো সার। যদিও বাইচান্স কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আশা মন থেকে তাড়াতে পারি না।
রিকশা ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। বা'পাশের আকাশছোঁয়া দালানটাকে পাশ কাটাতে কাটাতে মনে হলো আমাদের মাথার উপরে রডের আকাশ, ইলেকট্রিক বাতাসে আমাদের নিঃশ্বাস উঠছে নামছে। এজন্যেই বুঝি বুকের বাঁ'পাশটাতে এত ব্যাথা। মাটি কোথায়? কোথায় মাটির সোঁদা গন্ধ? তারপরেও থামে না আমাদের কংক্রীট জীবন। রিকশা ছুটে চলছে। ঘামে ও বৃষ্টিতে রিকশাওলার শার্ট পিঠের সাথে লেপ্টে গেছে। এমনকি কানের লতি বেয়েও নামছে ঘামের ধারা। আমার গাঁয়ে ফুর ফুরে বাতাসের আমেজ। হঠাৎ কে যেন ডাক দিলো-‌ ‌‌'শুভ', এই শুভ। "চমকে উঠে চারদিকে তাকালাম। কে ডাকলো? রিকশার গতির চেয়ে দ্বিগুণ বিস্ময় আমার মনে দোল খেলো। তারপর মনে হলো, আমি নিজে থেকেই ভাবছিলাম -আমার এই শ্যাম্পু করা বাতাসে উড়া চুল, ফর্সা ফ্যাসনেবল কাপড় আর শেভ করা লোশনড গাল দেখে পরিচিত কেউ ডাক দিক। আসলে হয়েছে কি, এই অবচেতন কল্পনার কথা প্রায়ই মনে থাকে না আমাদের। যার ফলে নিজেকে কিছু এটা ভাবতে বেশ আরামই বোধ হয়।
আমাদের বাসার পাশেই ক্ষীণ স্রোতা একটা খাল ছিলো। খাল পাড়ের এটেল মাটিতে আমরা ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট, নদী-পুকুর বানাতাম। বানানোর পর নাম দিতাম সোনার গাঁ। সোনার গাঁয়ের সোনার দিন থাকেনি বেশী দিন। তারপর লুংগি পরে ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে মফশ্বল শহরের চৌরাস্তায় মার্শাল'ল উপেক্ষা করে মিছিলের উত্তেজনাও হারিয়ে গেছে। এবং শেষ পর্যন্ত পিস্তল-পাইপগান হাতানোর স্বাদ পাওয়ার আগেই মনে হচ্ছে মাথার উপরে রডের আকাশ, পায়ের নীচে কংক্রীট জমিন।
তারপরেও সবকিছু ছাপিয়ে উকি দেয় তিথি। ‌শুভ কেমন আছো? "-শুনতে শুনতে আন্তঃনগর ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ হয়ে যায় রবীন্দ্র সংগীত।" আম্মা, এ হলো শুভ, চিনেছো তো। আমাদের বাসায় অনেক দিন গিয়েছে। "-বলতে বলতে তিথি খেয়াল করে শুভ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শুভ'র মাথায় তখন আলী আকবর খাঁর সেতার, বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই আর বিটোফোনের সোনেটা- সব গুবলেট পাঁকিয়ে গেছে। এবং এই পাথর অবস্থাতেই শুভ তিথিকে জিজ্ঞেস করে। কেমন আছো?"
কেমন আছে তিথি? তিথির হলুদ ওড়না, ঠোঁটের লিপস্টিক, নকশাদার স্যান্ডেল চিৎকার করে বলে -ভালো খুব ভালো। একেবারে প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয় "সুগন্ধার" মত ভালো। শুধুমাত্র গাঁদা ফুলগুলিকে যা একটু বিরক্ত লাগে। এছাড়া আর সব ঠিক ঠাক। গোলাপী শিফনের মতো মন, জর্জেট মেজাজ, ড্রাই করা হাসি-এসব নিয়ে কি আর খারাপ থাকা যায়?
তাহলে শুভ'র অবস্থাটা কি দাঁড়ালো? বৃত্তাবদ্ধ শৈশব, অবিকশিত কৈশোর, এবং ধাক্কা খাওয়া তারুণ্য নিয়ে কেমন আছে শুভ? শুভ, মানে আমি, মানে যে খাচ্ছে-ঘুমুচ্ছে, ফুকছে বেনসন সে কেমন আছে?
নিজের কথা আর কতটুকুই বা বলা যায়? রিকশা মগবাজার মোড়ে আসার পর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না ডানে-বামে না সোজা যাবো। একদিকে তিথি, একদিকে বৈভব এবং অন্যদিকে সারিন্দার টুংটাং-এর মতো নিরুদ্বিগ্ন হাভাতের জীবন। কিন্তু মুশকিল হলো কে যে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে- আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না। ডানে-ছিমছাম রাস্তার গা ঘেষে রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ কর্তা ও আমলাদের সুদৃশ্য আবাস। মন বলে ওদিকে যাই। কিন্তু আমার সাধারণ পা ওই অসাধারণ পথে যেতে সাহস পায় না। (আমি ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে গিয়েছি। পকেট ঝেড়ে রিকশাওলাকে বিদায় করতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। আমার হিসাব মতে প্রাপ্যের চেয়ে দুটাকা বেশী দেয়ার পরেও রিকশা ওলা আমাকে কেয়ামতের দিন দাবীর নীচে রেখে, ওর টাকা মেরে বড়লোক হতে পারবোনা-এই শাপ দিতে দিতে বিদায় হলো)। সোজা-ব্যস্ততা, গ্যাঞ্জাম- খালি মানুষের মাথা। রিকশার হুড আর কার- বাসের চলন্ত ছাদ। ছয় নম্বর বাসের কান ফাঁটা হর্ণে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। এ পথে এক্সপার্ট পকেট মারদের আনাগোনা উল্লেখ করার মতো। আমার ভীরু হৃদপিন্ড ওই পথে যেতে সায় দেয় না। এবং বামে আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নাই। ভীড়, ব্যস্ততা, গ্যাঞ্জাম-কম বলা যাবে না। তবেই কাছেই একটা রেলগেট আছে। এবং রেল গেট পেরিয়ে কিছুটা সামনে গেলে দেখলেও দেখা যেতে পারে, শাবানা, ববিতা, শাবনাজ, মৌসুমী নামের প্রাণীদিগকে। অবশ্য আমার মতে, রেললাইনটাই জীবনের তাবৎ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু পিছুটানহীন একমুঠো সাহস। ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেই সব ফকফকা।
যেদিন ২৬শে মার্চ সেদিন পার্কে ঢুকা নিষেধ, ১লা বৈশাখের কণ্ঠনালীতে বেয়নেটের বেরিকেড। বাঙালিকে গণতন্ত্র শেখানো হচ্ছে। যে গণতন্ত্রের ছোঁয়ায় হিরন্ময় পথিক ওরফে শুভ'র বুকের পশম কাঁপে , হাসতে হাসতে কাঁদতে ইচ্ছে করে। শুভ কোন দিকে যাবে ভেবে পায় না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে সূর্য্য একবার উকি দিলেও আকাশের অবস্থা তথৈবচ। ঘড়িতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে থেমে থেমে, মাঝে মধ্যে প্রচণ্ড ভাবে। শহরের কোন কোন রাস্তা নদী হয়ে গেছে। হায়! পদ্মায় পানি নাই এদিকে রাজধানীর রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। নিউ মার্কেটের ভিতরে হাঁটু সমান পানি। তারপরেও কেনা কাটার কমতি নেই। কাপড়-কসমেটিক, রঙিন পেন্সিল এবং রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা" সবই বিক্রি হচ্ছে। এবং ফুটপাতের পলিথিনের ছাউনিওলা বাসিন্দাদের জীবনও চলছে ভাবলেশহীনভাবে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শুভ'র অর্থাৎ আমার গায়ে জ্বর আসে। মাথায় অসংখ্য মানসিক যন্ত্রণার সাথে শারীরিক যন্ত্রণা জাড়িত হয়। তারপর অদ্ভুতভাবে আমি আমার যাবার পথ ঠিক করে ফেলি। তিথিতো কিছু দিনের মধ্যেই হোমরা-চোমরা কারো ঘরনী হয়ে যাবে। বৈভবের প্রচণ্ড ক্ষমতাও প্রয়োজন আছে মনে করেও এর প্রতি কোন টান অনুভব করি না। অতএব সমাধান রেললাইন।
অবশেষে হিরন্ময় পথিক ওরফে শুভ ভালয় ভালয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজে পৌঁছে। শুভ কোনদিন প্রমত্ত পদ্মা দেখেনি। আজ যা দেখছে তা আর নদী নেই ধু ধু বালুর মাঠ। শুভ নিজের জীবনের সব কষ্টকে এক জায়গায় জড়ো করে। আজ সে কষ্টের বিস্ফোরন ঘটাবে। পরিস্কার আকাশে ভরাট চাঁদ। নীল নয়, সাদা নয়- এমন আকাশের রঙ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের রেলের পাতের উপর শুভ শুয়ে আছে। জ্বরে ও ক্লান্তিতে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে স্বপ্নে দেখে: তার উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেছে। তার শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, রক্তাক্ত। তার শরীরের ফোটা ফোটা রক্ত পদ্মার বুকে পড়ছে। সেই রক্তের ছোঁয়ায় পদ্মা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। পাতাল ফুড়ে বেরিয়ে এসেছে পানির ধারা। পদ্মা ক্রমে ক্রমে তার আপন রূপ ফিরে পাচ্ছে। পদ্মা ফুঁসে উঠছে। পদ্মার ঢেউ আছাড় খাচ্ছে কিনারে। উথাল পাথাল ঢেউয়ের সাথে নাচছে রূপালি ইলিশ। মাছ ধরার ছোট্ট ডিংগি থেকে কোন 'কুবের' হাঁক ছাড়ছেঃ "ও মাঝি, নৌকা কোন গাঁয়ের?" শুভ বিরবির করে নিজের এপিটাফ উচ্চারণ করলোঃ "আমি পথিক, অবশেষে পথ খুঁজিয়া পাইয়াছি।"
এর কিছুক্ষণ পরেই ঘুমন্ত শুভ'র উপর দিয়ে একটা ট্রেন লম্বা হর্ণ বাজিয়ে ছুটে গেলো।

আন্তঃআভ্যন্তরীণ রোদ জল

শরতের তাঁতানো রোদের আড়ালে আর্টস বিল্ডিং-এর পাশের টিলার মতো উঁচু জায়গাটার ঢালে একটা বয়সী জারুল গাছের নিচে গোল হয়ে- ঠিক গোল নয় একদিক কমলালেবুর মতো আর অন্যদিক ডিমের একটু চোখা দিকের মতো করে বসে আছে ওরা-পিকু, রাহাত, শ্যামল, দ্বীপ আর শুভ। বসার আকৃতিটা ডিমের মতো হয়েছে শ্যামল আর দ্বীপের পা ছড়িয়ে বসার কারণে। বসে বসে লম্বা লম্বা ঘাসের ডগা ছিঁড়ছে আর যে যার মতো করে কেউ সুর ভাঙছে, কেউ আউড়াচ্ছে কবিতার পংক্তি। কলেজের করিডোরে দেখেছি... গলায় জোর দিয়ে গাইছিল দ্বীপ, এমন উদাস উদাস, সুখ-সুখ, উড়ুত ফুড়ুতু মুহূর্তে ‌'ভাইসব' বলে চিৎকার করে সবাইকে থামিয়ে দিল শ্যামল। তারপর খুব আস্তে করে বললো_ ‌'পেরেস্ত্রোইকা'। মানে?_ একসংগে এই প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হলো পিকু, শুভ আর রাহাতের কণ্ঠে। শ্যামল গলার স্বর আরো নামিয়ে বললো চারদিকে তাকিয়ে দেখো, কিছু বুঝা যায় কি?
ওরা যে জায়গাটাতে বসে আছে, তার সামনের রাস্তাটা নেমে গেছে ঢালু হয়ে। নেমে গিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে, যেন হারিয়ে গেছে কোথাও। রাস্তাও বোধ হয় পথ হারায় কখনো সখনো। পেছনের আর্টস বিল্ডিংটা শত বছরের পুরনো। ক্লাস রুমে কাঠের গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা। গায়ে সাদা রং মেখে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা। শ্যামলের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সবাই চারদিকে তাকিয়ে এসবই দেখছিল।
আজ এই পঞ্চ পাণ্ডবের কলেজে প্রথম দিন। ক্লাস শুরুর বেশ আগেই চলে এসেছে প্রথম কলেজ দিবস উদযাপনের উত্তেজনায়। ওরা প্রথমে বসতে চেয়েছিল-বিশাল দীঘির মতো পুকুরের বাঁধানো ঘাটে। কিন্তু ঘাটটা দখল হয়ে ছিল আগে থেকেই। ঘাটে-ক্যান্টিনে-গেইটে- অডিটোরিয়ামের সামনে দলবেঁধে যারা আড্ডা দিচ্ছে- তাদেরকে ঠিক এই কলেজের ছাত্র মনে হচ্ছে না। যদিও কলেজের কিছু বড় ভাই যারা ছাত্রনেতা হিসাবে পরিচিত তারা মোটর সাইকেলে করে কলেজের এমাথা ওমাথা চক্কর দিচ্ছিলো আর জটলার লোকজনদের সাথে কথা বলছিল।
শ্যামলের আকার-ইঙ্গিত আর কলেজের ভারি বাতাসের উৎকণ্ঠার মধ্যেও কলেজে আসার পথে পিকুর কাছে শোনা গল্পটার কথা ভাবছিল শুভ। পিকু গল্পটি শুনেছে গতকাল চুল কাটতে গিয়ে। চুল কাটতে কাটতে ফিসফাস করে গোপনে বলার ভঙ্গিতে সুবল পিকুকে বলেছিল গল্পটা মানে বাস্তব ঘটনাটা। কলেজের আরো দক্ষিণে যেখানে ঘন জঙ্গলের শুরু, সেই জঙ্গল থেকে কিছুদিন ধরে নাকি রাতের দ্বি-প্রহরে জ্বলজ্বলে নীল চোখের এক অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী আলুথালু বেশে এলোকেশে বের হয়ে শহরের মূল সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যায় উত্তর দিকে। বিমানবন্দরে যাবার একটু আগে দুইশত বছরের পুরনো চা বাগানের বিপরীত দিকে ছোট ছোট পাহাড়ের বাঁক ধরে যে পায়ে চলা পথ চলে গিয়েছে-মেয়েটি সেই পথে ঢুকে হারিয়ে যায়। এমনটি ঘটছে বেশ কিছুদিন ধরে। তবে মেয়েটিকে নিজের চোখে দেখেছে এমন প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পিকু এখনো পায়নি।
বিশ্বের এখানে সেখানে পট পট করে ভেঙ্গে যাচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার পদ্ধতি। পৃথিবীটা কেমন যেন এক কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ধর্ম যদিও বলে, স্রষ্টার সাথে কাউকে শরিক না করতে। কিন্তু বর্তমান বাস্তব বিশ্বনিয়ন্তারা বলে-সবাই আমার সাথে শরিক হয়ে যাও। ভাবে ভব্যে আমার হয়ে যাও। অন্যথায় কালো পেট মোটা প্লেন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সজ্জিত ধবধবে সাদা ও উচুঁ সৈন্যদল। তারা তোমাদেরকে ডেমোক্রেসি শিক্ষা দিবে, ইচ্ছামতো হত্যা করবে এবং তোমাদের পূর্বতর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পূরাকীর্তি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যে পরিণত করে দিবে। এসব ভেবে ভেবে কেমন গা গুলাচ্ছিল শুভর। শুভ পিকুকে বললো দ্যাখ দ্যাখ- ঐ সব জটলা থেকে কেমন যেন হিংস্র ধোঁয়া উড়ছে।
পিকু অবশ্য শুভর কথা না ধরে গতকাল শোনা গল্পের প্রসঙ্গটা আবারো উঠালো। পিকুর মাথায় বেশ ভালভাবেই ভর করেছে ব্যাপারটা। অবশ্য শুভও খুব আলোড়িত এই ঘটনায়। বেশ কিছু দিন ধরে রাতের শহর অবলোকনের জন্য পিকুকে টুশকী দিচ্ছিল শুভ। প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে করতে এই নীলচক্ষু কিশোরীর কাহিনী শুনে দুইজনই খুব উজ্জীবিত। এখন তো আর দেরি করা চলে না। এমন অদৃশ্যপূর্ব নীল নয়নাকে না দেখলে-জীবনের আর থাকল কী, এমন অবস্থা। শেষ পর্যন্ত নৈশ অভিযানের সহযাত্রী হতে রাজি হলো রাহাতও। এর আগে অবশ্য রাহাত আর শুভ মিলে এক বিলুপ্তপ্রায় উপজাতির অনেক অজানা খোঁজখবর বের করে এনেছে-রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ছাতার আড়ালে পাত্র রমণীর মুখ খুঁজে-খুঁজে।
আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘাসের আড্ডা ছাড়ল সবাই। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা গেল চপ-সিঙ্গারা সব শেষ। আছে শুধু বোয়ামের তলানীতে কিছু বিস্কুট আর চা। চা আর বিস্কুটেই কলেজের প্রথম দিনের টিফিন সারল ওরা। টিফিন সেরে ফিজিক্স বিল্ডিংএর সামনে গেল পাঁচজন। প্রথম ক্লাস ফিজিক্স। এই ফিজিক্স বিল্ডিং আবার আর্টস বিল্ডিং থেকে অনেক দূরে লাইব্রেরি, ক্যান্টিন ছাড়িয়ে কলেজেরে সীমান্ত ঘেঁষে যে ছোট ছড়াটা বয়ে গেছে তার লাগোয়া। সায়েন্সের ছাত্র হলেও পিকুর খুব ইচ্ছে ছিল প্রথম ক্লাসটা আর্টস বিল্ডিং-এর কাঠের গ্যালারিতে বসে করতে। কিন্তু তাতো আর হচ্ছে না।
ক্লাস শুরুর এখোনো কিছুটা সময় বাকি। অনার্সের কী একটা পরীক্ষা চলছে। ক্লাসের সামনের ভিড় ঠেলে শুভ গিয়ে দাঁড়ালো ছড়ার পাশে। পরিষ্কার পানির ছোট স্রোতটি হেলেদুলে চলে যাচ্ছে। স্রোতের পানিতে প্রতিফলিত শরতদুপুরের রোদ চিকচিক করছিল। শুভ খুব অবাক হয়ে দেখছিল এই রোদ জলের খেলা। যেন রোদ জলের সাথে লুকোচুরি খেলছে শুভর স্বপ্ন। এমন সময় একটা বিকট শব্দে রোদ জল আর স্বপ্নের খেলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসেব শুভ। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দূরে পুকুরের ওই ঐপাড়ে অডিটোরিয়ামের সামনে ধোঁয়া আর ছুটাছুটি। ফিজিক্স বিল্ডিং-এর সামনের জটলাটা ভেঙ্গে গেছে। যে যেদিকে পারে ছুটছে। পিকু কোথায়? রাহাত, শ্যামল, দ্বীপ?... অনেকের সাথে পড়িমরি করে ছড়া পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিকু আর রাহাতকে খুঁজে পেল শুভ। ব্যাপার কী? কী হয়েছে বলতো? শুভ চিৎকার করে প্রশ্ন করলো পিকু আর রাহাতকে। পিকু খুব আস্তে শ্লেষের সাথে উচ্চারণ করলো... পেরোস্ত্রাইকা। মানে?-শুভর কণ্ঠে আবারো প্রশ্ন। মানে হলো... আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। কলেজে পড়তে এসে যারা নেতৃত্বের তকমা এঁটেছেন বুকে পিঠে মাথায়, তারাই এমন সাজ সাজ রব করে সংঘর্ষ বাধিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন। এখন তো কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। একটা ক্লাসও করা গেল না। বলতে বলতে শূন্যে মুঠি ছুড়ে ক্রোধ প্রকাশ করলো পিকু। আচ্ছা, আমরা বাড়ি যাব কীভাবে? একজন এসে জিজ্ঞেস করলো পিকুদেরকে। পিকু রাহাত শুভ ছাড়াও আরো ২০/২৫জন এই পথ দিয়েই বাড়ি যাবার পথ খুঁজছে। রাহাত বললো জঙ্গলের পর কয়েকটা টিলা আছে। সেই টিলা পার হলে পরে পাওয়া যাবে রাস্তা।
এই জঙ্গলটা খুব হালকা। বড়গাছ তেমন একটা নেই। বেশিরভাগই ছোট ছোট কাঁটার গাছ। পা বাঁচিয়ে পথ চলতে খুব কষ্ট। সামনের টিলাগুলি দু'হাত বাড়িয়ে কেমন যেন ডাকছে। টিলার বিস্তৃতি সোজা অনেক দূর পর্যন্ত। ডান দিকে ঘন জঙ্গল। শুভ ভাবছিল এই জঙ্গল থেকেই সেই নীল চোখ হরিণী বের হয়ে আসে কি-না।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা টিলার কাছাকাছি চলে এসেছে। বাম দিক ধরে টিলাটা পার হলেই বাড়ি যাবার রাস্তা। সোজা টিলার বিস্তৃতি-জাদুজালের মতো কুহক- কেবলই হাতছানি দিয়ে ডাকে। পেছনের-অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের কলেজ তাড়িয়ে দিয়েছে। ডানের জঙ্গলে কি সত্যি থাকে পরিবেদনার ভাষা নীল চোখের অপূর্ব কিশোরী! সাথের সবাই ততক্ষণে বাড়ি যাবার রাস্তায় উঠে রিক্সা খুঁজছে। টিলার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত, শুভ, পিকু- ঘোর লাগা, চাঁদে পাওয়া মানুষের মতো।

মিছিলে পেতেছি বুক

মিছিলে পেতেছি বুক
বন্দুকের দিকে
এ গুলি লাগবেনা কখনো পিঠে
বুক ভেদ করে যতদুরে গেলে পরে
আঁকা হবে গুলি ও রক্তের আলপনা
নদী ও ধানের দেশ জানি
তার চেয়ে বেশি প্রসারিত করে দেবে বুক
রক্ত ও গুলির চিহ্ন দেখে চলি পথ
সম্মুখে স্বপ্ন ও অসীম সবুজ
থৈ থৈ ফসলের দিন

The Bookseller

http://www.thebookseller.com/tags-bookseller/ahmedur-rashid-chowdhury